বাবাহীন
১৮ বছর - রিক্ততা - শুন্যতা - অতৃপ্ততা
২১
অক্টোবর ১৯৯৮। বৃহস্পতিবার। মাগরিবের
আজানটা মাত্র দিচ্ছে। আজানের
শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে
এম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ। এম্বুলেন্স গিয়ে থামল
খুলনা
কিউর
হোম
ক্লিনিকের
সামনে।
বাবাকে
বের
করে
আনা
হলো
মুমূর্ষু
অবস্থায়।
ভর্তি
করানো
হলো।
ডাক্তাররা
দেখে
নিশ্চিত
করলেন
বাবার
ব্রেইন
স্ট্রোক
করেছে।
চিকিৎসা
শুরু
হলো।
আস্তে
আস্তে
অবস্থার
কিছুটা
উন্নতি
হতে
থাকল।
শনিবার
সকাল
নাগাদ
বাবার
জ্ঞান
ফিরল।
খুব
আস্তে
আস্তে
বাবা
কথা
বলতে
শুরু
করলেন।
আমার
সাথে
বলতেন
অনেক
কথা।
চলমান
মিনি
বিশ্বকাপ
ক্রিকেট
থেকে
শুরু
করে
দায়-দেনার
হিসাব
সব
বলে
গেলেন।
আমি
বুঝতে
পারলাম
দিন
শেষ
হয়ে
আসছে।
বাবা
বুঝতে
পারছেন
যে
তিনি
আর
থাকছেন
না।
এ
কারণে
এসব
হিসাব
আমাকে
দিয়ে
যাচ্ছেন।
ঠিক
ঠিক
মনে
করে
সব
দেনার
হিসাব
আমাকে
বললেন।
পরে
মিলিয়ে
দেখেছি,
এর
বাইরে
আর
কোনো
দেনা
ছিল
না
বাবার।
ঐদিনই
রাতে
আবার
ঘুমের
ভিতরেই
দ্বিতীয়বার
স্ট্রোক
হয়ে
গেল।
আর
জ্ঞান
ফিরল
না।
রবিবার
সন্ধ্যায়
মেডিকেল
বোর্ড
গঠন
করা
হলো।
তিন
জ্যেষ্ঠ
চিকিৎসক
বাবাকে
দেখে
নিজেদের
মধ্যে
বৈঠক
করে
নিলেন।
মেজ
মামাকে
তারা
ডাকলেন
তাদের
কার্যালয়ে।
আমিও
যেতে
চাইলাম।
কিন্তু
আমাকে
যেতে
দেওয়া
হলো
না।
আমি
কিছু
একটা
নিশ্চিত
জানতে
চাইলাম।
তাই
মামার
সাথে
ডাক্তারদের
ঐ
বৈঠকের
ঘরের
বাইরে
পর্দার
আড়ালে
লুকিয়ে
কান
পাতলাম।
ডাক্তাররা
মামাকে
জানালেন-
৯৫
ভাগ
সম্ভাবনা
হলো
কাল
সকালে
রোগীকে
আমরা
আর
পাব
না।
আমি
বুঝে
গেলাম
সবকিছু।
মা
টের
পাবে
বলে
বাবার
কেবিনে
গেলাম
না।
তিনতলার
সিঁড়িতে
বসে
কাঁদলাম
প্রচুর।
পাশের
কেবিনের
রোগীর
মেয়ে
এক
বড়
আপু
এসে
আমাকে
বুকে
জড়িয়ে
ধরে
জিজ্ঞাসা
করলেন
তুমি
এখানে
একা
একা
বসে
কাঁদছ
কেন?
আমি
বললাম-
আপু,
আজ
রাতেই
আমার
বাবা
মারা
যাবেন।
আপু
আমাকে
সান্তনা
দিলেন।
কাঁদতে
কাঁদতে
একসময়
আমি
ঘুমিয়ে
পড়লাম।
ঘুম
যখন
ভাঙ্গল,
তখন
সময়
প্রায়
ফুরিয়ে
এসেছে।
বাবা
আস্তে
আস্তে
আরো
বেশি
নিস্তেজ
হয়ে
পড়ছেন।
কর্তব্যরত
চিকিৎসক
বারবার
বাবার
বিভিন্ন
পরীক্ষা
করছেন
আর
ফাইলে
ফলাফল
লিখছেন।
নাড়ির
স্পন্দন
পরীক্ষা
করছেন
একটু
পরপর
আর
ফলাফল
লিখছেন-
‘নো
ট্রেইস’। এক
সময়
অক্সিজেনের
বুদবুদ
ছোট
থেকে
আরো
ছোট
হয়ে
আসতে
লাগল।
আরো
পরে
যেন
থেমেই
যেতে
লাগল।
মা
আমাকে
ডেকে
ডুকরে
কেঁদে
উঠে
বললেন-
‘বাপ্পা,
তোর
বাবার
মুখে
জল
দে...’। আমি
চামচে
করে
বাবার
মুখে
জল
দিলাম।
প্রথম
চামচ
জল
বাবার
মুখে
ঢুকল।
কিন্তু
দ্বিতীয়
চামচ
গাল
গড়িয়ে
পড়ে
গেল।
রবিবার
মাঝরাত
পার
হয়ে
২৫
অক্টোবর
১৯৯৮,
সোমবার,
দিবাগত
রাত
১২.৫০।
ডাক্তার
অক্সিজেনের
নল
খুলে
নিয়ে
ফাইলে
শেষবার
লিখলেন-
‘পাসড্
এওয়ে’। আমি
আর
ধরে
রাখতে
পারলাম
না
নিজেকে।
হাউমাউ
করে
কেঁদে
উঠলাম।
বাবার
মরদেহ খুলনা থেকে এম্বুলেন্সে
নিয়ে ফুলতলার সিকিরহাটে মামারবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো।
দাদুকে একবার দেখিয়ে বাবাকে
নিয়ে এম্বুলেন্স ছুটল বাড়িল দিকে।
যশোরের রূপদিয়া বাজারে আমাদের বাড়ির
সামনে যখন এম্বুলেন্স দাঁড়াল,
তখন সোমবার ফজরের আজান
দিচ্ছে।
সকাল হতেই বাড়ি ভর্তি
লোক। সেদিন ছিল হাটবার।
হাটের সব ব্যবসায়ী সেদিন
সিদ্ধান্ত নিলেন তারা কোনো
ধান-পাটসহ মালামাল কেনা-বেচা করবেন না।
হাটের সব লোক তখন
আমাদের ইটবিছানো উঠোনে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়,
বালিকা বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয় এমনকি স্থানীয় দাখিল
মাদ্রাসাটিও সেদিন ছুটি ঘোষণা
করা হলো। দুপুরের পর
বাবার শবযাত্রা যখন শ্মশানের দিকে
এগিয়ে চলেছে, তখন রাস্তার
দুইধারে অজস্র লোকের সারি।
শবযাত্রী হাজার পার হয়ে
গেল।
কি নির্মম! বড় ছেলে হিসেবে
আমাকেই সেই ছোট্ট বয়সে
বাবার মুখে আগুন দিতে
হলো! এ কেমনতর বিধান!
এক সময় বাবার দেহটি
পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
আর শূন্য রিক্ত হাতে
কেবল অশ্রু আর অসহায়ত্ব
নিয়ে আমরা ফিরে এলাম
বাবাহীন বাড়িতে।
আমার
বাবা। স্বর্গীয় দুলাল চন্দ্র বসু।
তিনি আজ নেই। নেই,
তাও তো পনের বছর
হলো। কিন্তু বাবার স্মৃতি
ছড়িয়ে আছে যশোরের রূপদিয়া,
মামারবাড়ি ফুলতলা, আমাদের আদিভিটা সাতক্ষীরার
তালা উপজেলার পাটকেলঘাটার কুমিরা গ্রাম থেকে
শুরু করে বাবার কৈশোর-যৌবনের বিচরণক্ষেত্র ভারতের
পশ্চিমবাংলার দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা
জেলার মালঞ্চ-মাহিনগর-সোনারপুর-পঞ্চবটীর বাঁকে বাঁকে। আর
আমাদের সকল মানসপট জুড়ে।
এখানে বাবার সততা, বিচক্ষণতা
আর লোকপ্রিয়তা তো আমি দেখেছি
আমার জ্ঞান হবার পর
থেকেই। কিন্তু বাবার শিকড়সন্ধান
করতে গিয়েছিলাম বছর দুয়েক
আগে ভারতে। ঐ
জনপদের মানুষের কাছে বাবাকে যেভাবে
চিনলাম, তা আমাকে কেবল
অভিভূত আর এমন বাবার
সন্তান হিসেবে গর্বিত করেছে।
সব বাদ দিয়েও ওখানকার
জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের মুখে শোনা একটি
কথা দিয়েই আমার বাবাকে
চিনতে পেরেছি- ‘তোমার বাবা ছিলেন
আমার সময়ে তরুণদের রোলমডেল’।
এই
দীর্ঘ সময়ে বাবার শূন্যতা
শুধুই আমাকে কষ্ট দিয়েছে।
স্বপ্নে-মননে কেবল বাবাই
জড়িয়ে আছেন। বাবার আদর্শ,
বাবার জীবনবোধ আমাকে শত কষ্ট,
শত দারিদ্র্য, শত অনটন আর
শত ক্ষুধার মধ্যেও শান্তি দিয়েছে।
আমি আজকের যে আমি,
তার অনেকটাই আমার বাবার কারণে।
ইহকাল-পরকালের কোনো সংজ্ঞা-দর্শন
আমি জানি না, বুঝি
না। কিন্তু এ জানি
যে আমার বাবা আমাকে
দেখছেন। ছায়ার মতো জড়িয়ে
আছেন আমার সাথে। আমি
আজ যদি আমার কর্মের
জন্য, আমার সংগ্রামের জন্য
মানুষের এক বিন্দু ভালবাসাও
পেয়ে থাকি, তবে নিশ্চয়ই
আমার বাবা আজ পুলকিত
হচ্ছেন স্বর্গে বসে। বাবাকে আমি
যদি একচুলও গর্বিত করতে
পারি, তবেই আমার বাবার
শান্তি।
আমার
এক সময়ের মঞ্চ
অভিনয়, আমার আবৃত্তি, আমার
পঠনঅভ্যাস, আমার কাজের প্রতি
নিষ্ঠা, আমার মানুষের প্রতি
দায়বোধ, আমার রাজনীতি সচেতনতা-
সবই আমি পেয়েছি আমার
বাবার হাত ধরে।
বাবা,
তোমাকে আমি খুব, খুব,
খু-উ-ব ভালবাসি।
বাবা, আমার হাতটা যে
বড় খালি খালি লাগে।
কিন্তু বাবা আমাকে আজও
জড়িয়ে ধরে রেখেছেন।
আমার
বাবার মতো বাবা পৃথিবীতে
আর কেউ নেই, হবেও
না। আমার বাবা পৃথিবীর
শ্রেষ্ঠ বাবা। আমি শুধু
আমার বাবার মতো মানুষ,
আমার বাবার মতো বাবা
হতে চাই।
আজ
আমি নিজে
বাবা হয়েছি।
আমার সন্তান যেন ভবিষ্যরে কোনো এক সময়ে তার বাবার
সুলুকসন্ধান করে আমার বাবার
মতো এক অতীত
পায়, সেটাই কামনা।
No comments:
Post a Comment